ঘাতক ব্যাধি এইচআইভি/এইডসের কথা আজ আর কারো অজানা নয়। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার কারণে এ বিষয়ে অনেক সচেতনতার সৃষ্টি
হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সমীক্ষায় বর্তমানে পৃথিবীতে ৩৩·২ মিলিয়ন নারী-পুরুষ এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত বলে জানা যায়। এইচআইভিতে আক্রান্ত মহিলার সংখ্যা হচ্ছে ১৫·৪ মিলিয়ন আর নিষ্পাপ শিশুর সংখ্যা প্রায় ২·৫ মিলিয়ন। ২০০৭ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২·৫ মিলিয়ন নারী-পুরুষ নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয় আর এ বছর এইডসের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা হচ্ছে ২·৪ মিলিয়ন। ১৯৮১ সালে প্রথম মানব দেহে এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এ পর্যন্ত মোট ২·৫ মিলিয়ন নারী-পুরুষ এ রোগের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পৃথিবীতে যতো এইচআইভি/এইডসের রোগী রয়েছে তার প্রায় ৬১ শতাংশই সাব সাহারান আফ্রিকার অধিবাসী। ব্যাপক প্রচারণার কারণে এইচআইভির ভয়াবহ চিত্র আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হলেও প্রয়োজনীয় প্রচারণার অভাবে এইচআইভির মতোই আর এক প্রাণসংহারী ব্যাধি ‘হেপাটাইটিস বি’ রয়ে গেছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে।
নীরব ঘাতক এ সংক্রামক ব্যাধিটি প্রতি মিনিটে কেড়ে নেয় দুজন নারী-পুরুষের প্রাণ। পৃথিবীতে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন অর্থাৎ দুই বিলিয়ন নারী-পুরুষই হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত। পৃথিবীর প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন নারী-পুরুষ দীর্ঘ মেয়াদের জন্য তাদের দেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের জীবাণু বহন করে চলছে। প্রতি বছর ১০-৩০ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হচ্ছে। হেপাটাইটিস বি ও এ রোগের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রতি বছর এক মিলিয়ন মানব সদস্য প্রাণ হারায়। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা এইচআইভি ভাইরাসের চেয়ে শতগুণ বেশি আর এ দুটো রোগ প্রায় একই উপায়ে সংক্রমিত হয়। বয়স্কদের তুলনায় শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক রোগীদের ওপর এ রোগের দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব অধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। এইচআইভির চেয়ে এ রোগ অধিক ভয়ঙ্কর হলেও আশার বিষয় হচ্ছে এইচআইভি প্রতিরোধে অদ্যাবধি কোনো প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে বাজারে রয়েছে পর্যাপ্ত ও কার্যকরী টিকার ব্যবস্থা।
হেপাটাইটিস বি কি ও কতো প্রকার?
হেপাটাইটিস বি লিভার বা যকৃতের এক ধরনের প্রদাহ বা ইনফেকশন। হেপাটাইটিস বি সাধারণত স্বল্প মেয়াদি (একিউট) যার স্থায়িত্ব ছয় মাসের কম এবং দীর্ঘ মেয়াদি (ক্রমিক) যার মেয়াদকাল ছয় মাসের বেশি হয়ে থাকে। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াসহ নানা কারণে যকৃতে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, তবে ভাইরাসজনিত কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। হেপাটাইটিস ভাইরাস সাধারণত ছয় ধরনের (অ, ই, ঈ, উ, ঊ, এ)। হেপাটাইটিস বি এক ধরনের ডিএনএ ভাইরাস।
হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি কাদের বেশি
* অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী যেমন সাব সাহারান আফ্রিকা, এশিয়ার অধিকাংশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসী ও আলাস্কার আদি অধিবাসীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি রোগের প্রকোপ অন্যদের তুলনায় অধিক।
* রক্তক্ষরণ ও অন্যান্য কারণে সৃষ্ট রক্তশূন্যতার চিকিৎসায় বারবার বস্নাড ট্রান্সফিউশন গ্রহণ করা হলে।
* কিডনি বিকল হওয়ার কারণে ডিমোডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হলে।
* সমকামী পুরুষদের মধ্যে যৌন মিলনের ফলে।
* হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত নারী-পুরুষের মধ্যে এবং একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলন।
* ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক দ্রব্য সেবন।
* একই নিডল ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তির মাদক দ্রব্য গ্রহণ।
* রোগীর দেহ থেকে রক্ত সংগ্রহ, স্যালাইন বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করার সময় কিংবা ল্যাবরেটরিতে রক্ত ও রোগীর দেহ থেকে সংগৃহীত তরল পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় অসাবধানতাবশত হেপাটাইটিস বি সংক্রমিত রক্ত কিংবা অন্য তরল জাতীয় পদার্থ স্বাস্থ্য কর্মীদের রক্তের সংস্পর্শে এলে।
* হেপাটাইটিস বি রোগের প্রাদুর্ভাব অধিক- এ ধরনের এলাকায় ছয় মাসের অধিক সময় অবস্থান করা।
* নার্সিং হোমে দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান বা কর্মরত থাকা।
* হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত মায়ের গর্ভজাত সন্তানদের অনাক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানদের তুলনায় হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অধিক।
হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হলে বোঝার উপায় কি?
উল্লিখিত যে কোনো উপায়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের জীবাণু দেহে অনুপ্রবেশ করার পর রোগের লক্ষণ দেখা দিতে এক থেকে দুমাস সময় লাগতে পারে। আর এ সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড (ওহপঁনধঃরড়হ চবৎরড়ফ)। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহের ওপর ভিত্তি করে রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ ভিন্ন ধরনের হতে পারে। শিশু ও যুব বয়সের ছেলেমেয়েরা একিউট হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ তেমন একটা দেখা যায় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য লক্ষণ থেকে শুরু হয়ে লিভার অকেজো ও মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে। যেসব লক্ষণ দেখে হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণ বোঝা যায় তার মধ্যে রয়েছে গা মেজ মেজ করা, অবসাদ অনুভব করা, মাথা ব্যথা, গা চুলকানো, গেটে ব্যথা বিশেষ করে ডান দিকের উপরিভাগে ক্ষুধামন্দা, বমিভাব থেকে শুরু করে বমি হওয়া, জ্বর অনুভূত হওয়া, চোখ ও প্রস্রাবের রঙ হলুদ হওয়া, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অনুভব করা ইত্যাদি। লিভারের দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহের কারণে শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদগ্রস্ততা ছাড়া আর কোনো লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। তবে দীর্ঘ দিনের প্রদাহের কারণে কারো কারো বেলায় লিভার অকার্যকর হয়ে কিংবা সিরোসিসের মতো জটিল উপসর্গের কারণে নানা লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আর এ অবস্থাকে এন্ড স্টেজ লিভার ডিজিজ বলা হয়।
হেপাটাইটিস বি নিরূপণের উপায় কি?
রোগের লক্ষণ প্রাথমিকভাবে বলে দেবে আপনি সম্ভবত হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে রক্ত পরীক্ষাই হচ্ছে নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত উপায়। রক্তে হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেন (ঝঁৎভধপব অহঃরমবহ), হেপাটাইটিস বি আইজিএম কোর অ্যান্টিজেন (ওএগ পড়ৎব ধহঃরমবহ), হেপাটাইটিস বি ই এন্টিজেন (ব ধহঃরমবহ) ও সেই সঙ্গে লিভার এনজাইমের অধিক মাত্রা নিশ্চিতভাবে হেপাটাইটিস বি-এর একিউট সংক্রমণের কথা বলে দেবে। ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদি হেপাটাইটিস বি নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তে হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেনের দীর্ঘ মেয়াদি উপস্থিতি, হেপাটাইটিস বি কোর আইজিজি (ওমএ) অ্যান্টিজেন, হেপাটাইটিস ই এন্টিজেন ও লিভার এনজাইম পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। আর সময়ের ব্যবধানে বি ভাইরাস আপনার দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে গেলে রক্তে হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে এবং ভবিষ্যতের জন্য হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধক হেপাটাইটিস বি কোর এন্টিবডি ও বি সারফেস অ্যান্টিবডি তৈরি করবে।
হেপাটাইটিস বি-এর দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব কি?
হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই কোনো প্রকার চিকিৎসা ব্যতিরেকেই আরোগ্য লাভ করে থাকে। পাচ বছর বয়সের আগে আক্রান্ত শিশুদের শতকরা ৯০ জনই লিভারের ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহে ভুগতে থাকে। বয়স্কদের মধ্যে এ সংখ্যা হচ্ছে পাচ থেকে দশ ভাগ। ক্রনিক প্রদাহে আক্রান্ত রোগীদের শতকরা একজন প্রতি বছর চিকিৎসা ছাড়াই জীবাণু বিমুক্ত হয় আর শতকরা ৩০ জন লিভার সিরোসিসের মতো মারাত্মক জটিলতায় ভুগতে থাকে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত রোগীদের শতকরা পাচ থেকে দশজন লিভার ক্যান্সার বা হেপাটোসেলুলার কারসিনোমায় আক্রান্ত হয়।
হেপাটাইটিস বি রোগের কোনো চিকিৎসা আছে কি?
হেপাটাইটিস বি রোগের সফল চিকিৎসার জন্য খুব বেশি কার্যকরী ওষুধ না থাকলেও ইনটারফেরন, লেমিবুডিন, এডিফোবির, এন্টিকাবির ও টেলিবিবুডিন জাতীয় ওষুধ এফডিএ কর্তৃক অনুমোদিত। এ ধরনের ওষুধ সাধারণত চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা প্রয়োজন হয় আর এসব ওষুধ হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসায় শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকরী। দীর্ঘ মেয়াদি ইনফেকশনের কারণে লিভার অকার্যকর হয়ে গেলে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়ে।
হেপাটাইটিস বি থেকে বাচার উপায় কি?
যেহেতু এ রোগের তেমন কার্যকরী ও সফল চিকিৎসা নেই, সেহেতু প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই এ ধরনের প্রাণসংহারী ব্যাধি থেকে বাচার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে দেহে প্রতিষেধক এন্টিবডি তৈরি করার লক্ষ্যে তিনটি প্রতিষেধক টিকা নেয়া প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় শিশু জন্মের দুই থেকে তিন দিনের মাথায় হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া হয়। দ্বিতীয় ডোজ এক থেকে দুমাসের মধ্যে আর তৃতীয় ডোজটি প্রথম ডোজের ছয় মাসের মাথায় দেয়া প্রয়োজন হয়।
গ্ল্যাক্সোর তৈরি টুইন রিকস ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটির সাত দিন পর দ্বিতীয় ডোজ, ২১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তৃতীয় ডোজ এবং এক বছর পর একটি বুস্টার ডোজ দিয়ে ভ্যাকসিনেশন সিরিজ সমাপ্ত করা যায়।
স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির জন্য কোনো প্রকার বুস্টার ডোজ নেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কোনো কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে গেলে বুস্টার ডোজ নেয়া প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিষেধক টিকা ছাড়াও এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইটিস বি ও সি-এর মতো মরণব্যাধিসহ সিফিলিস ও গনোরিয়া জাতীয় যৌন ব্যাধির হাত থেকে বাচতে হলে ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচর্যা ও ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন অতীব প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment
Thanks For Your Comments.